প্রকাশিত: Sun, Aug 13, 2023 11:06 PM
আপডেট: Tue, May 13, 2025 1:00 PM

[১]সাজানো ভিডিও দিয়ে ভারতে যেভাবে ধর্মীয় ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে

ইকবাল খান: [২] ভারতে লাখ লাখ মানুষ দেখেছে এবং শেয়ার করেছে এমন একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যে এক ব্যক্তি কালো বোরকা পরিহিত একজনকে আক্রমণ করছে। বোরকা পরিহিত ব্যক্তির হাতে ধরা একটি শিশু। আক্রমণকারী জোরপূর্বক ওই লোকটির বোরকা খুলে ফেললে তার পরিচয় জানা যায়। সূত্র: বিবিসি বাংলা।

[৩] এই ভিডিওটির সাথে যুক্ত করে দেওয়া হিন্দি এক বার্তায় লোকজনকে বোরকা পরিহিত অপরাধীদের ব্যাপারে “সতর্ক থাকতে” বলা হয়েছে। কারণ অপরাধীরা এটি ব্যবহার করে নিজেদের পরিচয় লুকিয়ে রাখে এবং “শিশুদের অপহরণ” করে। সারা বিশ্বেই অনেক মুসলিম নারী এই পোশাকটি পরেন।

[৪] এবছরের শুরুর দিকে এই ভিডিওটি ইউটিউবে পোস্ট করা হয় এবং ডিলিট করার আগ পর্যন্ত এটি প্রায় দুই কোটি ৯০ লাখ বার দেখা হয়েছে।

[৫] ভিডিওটিতে যা দেখানো হচ্ছে তা প্রকৃত কোনো ঘটনা নয়। এটা একটা নাটক এবং অপেশাদার অভিনেতারা এটি তৈরি করেছে।

[৬] এধরনের সাজানো ভিডিও, যা মূলত বিনোদনের জন্যে তৈরি, সেগুলো ভারতের সোশাল মিডিয়াতে সত্য ঘটনা হিসেবে তুলে ধরে শেয়ার করা হচ্ছে এবং এই প্রবণতা ক্রমশই বাড়ছে।

[৭] ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি ২০১৪ সালের মে মাসে ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়, বিশেষ করে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে উত্তেজনার ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

[৮] এসব মিথ্যা বক্তব্য বিভিন্ন সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে দেওয়া হয়, এর পাশাপাশি এগুলোকে নারীর বিরুদ্ধেও ব্যবহার করা হচ্ছে।

[৯] এসব সাজানো ভিডিও ভারতের বিভিন্ন ভাষায় তৈরি করা হচ্ছে- হিন্দি, তামিল, মালয়লাম, গুজরাটি, মারাঠি এবং তেলেগু। কখনো কখনো স্থানীয় মিডিয়াও এসব ভিডিওকে ভুল করে সংবাদ হিসেবে প্রচার করে থাকে।

[১০] গত কয়েক বছরে ছিনতাইকারী মনে করে ক্রুদ্ধ জনতার হাতে কয়েকজন আক্রমণের শিকার হওয়ারা পর অনেক রাজ্যে কর্তৃপক্ষ এধরনের ভুয়া খবরের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছে।

[১১] শুরুতে বোরকা পরিহিত লোকটির যে ভিডিওটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, অল্ট নিউজ তার সত্যতা যাচাই করে দেখেছে যে আসল ভিডিওটিতে সতর্কবার্তা ছিল। তাতে বলা হয়েছিল যে “এটি একটি ফিকশন বা কল্পিত ঘটনা’। কিন্তু বার্তাটি মাত্র এক সেকেন্ডের জন্য দেখা গেছে।

[১২]  বিভিন্ন ভাষায় তৈরি এরকম একটি ভিডিওতে, যা ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে ভাইরাল হয়েছিল, কোনো ধরনের তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই তাতে দেখানো হয়েছে যে মুসলিম পুরুষরা খাবারের সঙ্গে মদ মিশিয়ে হিন্দু নারীদের মাতাল করে ফেলার চেষ্টা করছে।

[১৩] এই ভিডিওর নিচে করা মন্তব্য থেকে ধারণা করা যায় অনেকেই এই দাবি সত্য বলে বিশ্বাস করেছেন। কেউ কেউ ইসলাম-বিদ্বেষী মন্তব্যও করেছেন। যেমন একজন লিখেছেন: লাভ জিহাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন।”

[১৪] মুসলিম পুরুষ প্রেমের ফাঁদে ফেলে হিন্দু নারীদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করছে এমন একটি ষড়যন্ত্র “লাভ জিহাদ” নামে পরিচিত।

[১৫] হায়দ্রাবাদ-ভিত্তিক ভেঙ্কট সিপানার তৈরি বেশিরভাগ ভিডিওতে সিসিটিভির মতো দেখতে রেকর্ডিং সাইন ও টাইম-স্ট্যাম্প ব্যবহার করা হয়েছে। তার ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ১২ লাখের বেশি এবং সেখানে ৪০০-এর বেশি ভিডিও পোস্ট করা হয়েছে।

[১৬]একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যে এক দর্জি একজন নারীর সাথে অসদাচরণ করছে। এটি টুইটার ও ফেসবুকে বেশ কয়েকবার শেয়ার করা হয়েছে।

[১৭] এতে দাবি করা হচ্ছে যে একজন মুসলিম পুরুষ হিন্দু এক নারীর সাথে খারাপ আচরণ করছে।। তাতে বলা হয়েছে: “হিন্দু বোন ও কন্যাদের অনুরোধ করা হচ্ছে তারা যেন মুসলিমদের দোকানে না যান, তারা খারাপ মানসিকতার মানুষ।”

[১৮] সিপানা বিবিসিকে বলেছেন যে “বাস্তব জীবন তুলে ধরা ও সচেতনতা তৈরি করার জন্য” তিনি এসব ভিডিও তৈরি করেছেন।

[১৯] আলিশান জাফরি নামের একজন সাংবাদিক, যিনি এধরনের ভুয়া খবর নিয়ে গবেষণা করেন, তিনি বলছেন- এধরনের সাজানো ভিডিও হয়তো শারীরিক সহিংসতার জন্ম দেয় না, কিন্তু এগুলোকে ধর্মীয় পক্ষপাতকে আরো গভীর করে।

[২০] “যেসব বিষয় সমাজকে বিভক্ত করে রেখেছে এসব ভিডিও সেগুলোকে উস্কানি দিচ্ছে। বেশিরভাগ ভিডিও নির্দিষ্ট কিছু সম্প্রদায়, বিশেষ করে মুসলিমদের উদ্দেশ্যে তৈরি করা। এগুলো যখন ভাইরাল হয়ে যায় - তখন সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংস মনোভাব তৈরি হয়,” বলেন তিনি।

[২১]  ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের মালিক কোম্পানি মেটার একজন মুখপাত্র বলেছেন, “ফেসবুকে যেসব কনটেন্ট সহিংসতা ছড়াতে পারে সেগুলোর বিষয়ে নীতিমালা পরিষ্কার, এগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।”

[২২] আরেকটি সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্স - যা আগে টুইটার নামে পরিচিত ছিল - তারা স্বয়ংক্রিয় জবাব পাঠিয়ে বলেছে যে তারা এবিষয়ে বিবিসির সঙ্গে “দ্রুত যোগাযোগ” করবে।

 [২৩] দিল্লি-ভিত্তিক সংস্থা ইন্টারনেট ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের নীতি-বিষয়ক পরিচালক প্রতীক ওয়াঘরে বলেন, “এই সমস্যার একটা দিক হচ্ছে মিডিয়া ব্যবহারে লোকজনের দক্ষতার অভাব, কিন্তু এটা এমন এক সমাজে ঘটছে যেখানে নানা ধরনের বিভাজন রয়েছে এবং লোকজন সেভাবেই ভাবছে।” তবে একটি ভিডিও সাজানো কি না সেটা পরীক্ষা করে দেখার উপায় আছে।

[২৪] ভারতে তথ্য যাচাইকারী সংস্থা নিউজচেকারের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক রুবি ধিঙরা বলেছেন ভিডিওর ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল, স্থান, প্রতিক্রিয়া এবং যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে তার ব্যাপারে লোকজনের সতর্ক থাকা দরকার।

[২৫] এসব খেয়াল করলেই তারা বুঝতে পারবে যে ভিডিওতে যাদের দেখা যাচ্ছে - তারা ক্যামেরা থেকে তাদের মুখ সরিয়ে রাখছে কিনা, অথবা তারা স্বাভাবিকের চেয়ে উচ্চস্বরে কথা বলছে কিনা, অথবা অতিরিক্ত অভিনয় করে ফেলেছে কিনা। ধিঙরা আরো বলেছেন সাজানো ভিডিওতে একটা ঘটনা যতোগুলো ক্যামেরায় এবং কোনো ধরনের বিঘ্ন ছাড়াই ধারণ করা হয়, বাস্তব কোনো ঘটনা সেভাবে ধারণ করা “একেবারেই সম্ভব নয়।”